সড়ক দুর্ঘটনাঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

হরহামেশাই টিভির স্ক্রলিং অথবা সংবাদ পত্রের শিরোনামে দুর্ঘটনার খবর পাই আমরা। মাঝেমাঝে মনে হয় এ যেন নিত্য নিমিত্তিক ব্যাপার! দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, মানুষ মরতেই পারে, জান-মালের ক্ষতি হতেই পারে! রাস্তায় বের হলেই মনে শঙ্কা কাজ করে, নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবো তো? অথবা পরিবারের যে মানুষটি অফিস অথবা কাজের প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হল সে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে তো? আমাদের নিরাপত্তা আছে তো?

গতকাল ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতেও বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, বিভিন্ন জায়গায় কয়েকজন মৃত্যু বরণ করেছেন এই সড়ক দুর্ঘটনায়। শুধু রাজশাহীর কাটাখালীতে এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জন। আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? আমরা কতটুকু নিরাপদ?

বলছি সড়ক নিরাপত্তার কথা। একটা বিষয় জানিয়ে রাখছি, আমরা “সেফটি ম্যানেজমেন্ট ফাউন্ডেশন” দুর্যোগ মোকাবিলা ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস নিয়ে কাজ করে থাকি। অগ্নিকান্ডে নিরাপত্তা, ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা, সড়ক নিরাপত্তা, ভূমিধ্বস, জরুরী উদ্ধার পদ্ধতি, বজ্রপাতে কারনীয়, বন্যা ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানান বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়াই আমাদের মূল কাজ। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এখন আমি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কিছু লিখছি।

সড়ক নিরাপত্তা কী?
নিয়ম মেনে নিরাপদে রাস্তায় চলাফেরা করে সুস্থতার সাথে ঘরে ফেরার নামই সড়ক নিরাপরত্তা।

সালমোট সড়ক দুর্ঘটনা নিহতআহত
২০১৭৮,৯৮৯ টি৭৩৯৭ জন১৬,১৯৩ জন
২০১৮৫,০১৪ টি৭,২২১ জন১৫,৪৪৬ জন
২০১৯৪,৭০২ টি৫,২২৭ জন৬,৯৫৩ জন
২০২০৪,৭৩৫ টি৫,৪৩১ জন ৭,৩৭৯ জন
বাংলাদেশে গত চার বছরের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য (সূত্রঃ প্রথম আলো, কালের কন্ঠ)

সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে [সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট ২৮, ২০১৭]
এই আর্থিক ক্ষতি বাংলাদেশে দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১.৬ শতাংশ বলে জানিয়েছে ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল (ইউএনইসকেপ)। [সূত্রঃ কালের কন্ঠ, ২৬ এপ্রিল, ২০১৮]

সড়ক দূর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ-

১. চালকদের অসাবধানতা, অদক্ষতা ও লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক।
২. সরু রাস্তা ও রাস্তায় ডিভাইডার না থাকা।
৩. পুরনো ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন।
৪. প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালানো এবং ওভারটেকিং দুর্ঘটনার জন্য অনেক বেশি দায়ী।
৫. সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতার অভাব।
৬. সড়ক বিষয়ক আইন প্রয়োগে এবং বাস্তবায়নের যথাযথ অভাব।
৭. প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশের অভাব ও ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ করা।
৮. বিকল্প যানবাহনের সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকা।
৯. জেব্রা ক্রসিং ওভারব্রিজের স্বল্পতা।
১০. সড়কের এবং ফুটপাতের ওপর অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা।
১১. অতিরিক্ত মালামাল ও অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ।
১২. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পথ অবরোধ, পথসভা, হরতাল প্রভৃতি কারণে যানজট সৃষ্টির ফলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে।
১৩. সড়ক পরিবহনের সাথে সম্পৃক্ত এক ধরণের কর্মচারীদের দুর্নীতিও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিকারের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো নেওয়া যেতে পারে:

১.সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিকারে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা এবং সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা।
২. সাবধানে গাড়ি চালানোর জন্য চালকগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
৩. লাইসেন্স প্রদানের পূর্বে চালকের দক্ষতা ও যোগ্যতা ভালভাবে যাচাই করা।
৪. প্রত্যেক চালককে সচেতন করা এই বিষয়ে যে, গাড়ি রাস্তায় বের করার পূর্বে এর যান্ত্রিক কার্যকারিতা পরীক্ষা করে নেওয়া।
৫. অনির্ধারিত স্থানে গাড়ী পার্কিং বন্ধ করা।
৬. জাল লাইসেন্স বন্ধ করা জরুরী। এ ব্যাপারে আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন।
৭. গাড়ি চালানোর সময় ড্রাইভারকে মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে
৮. বীমা আইনের আওতায় বীমার টাকা তোলার বিষয়টি আরও সহজ করা দরকার।
৯. রাস্তায় পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১০. ফুটপাত দখলমুক্ত করে পথচারী চলাচলের উপযোগী করে তোলা।
১১. গাড়ির ধারণ ক্ষমতার বাইরে মালামাল ও যাত্রী বহন বন্ধ করতে হবে।
১২. ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
১৩. সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
১৪. পথচারী, যাত্রী এবং চালকদের সচেতনতা বৃদ্ধির করার লক্ষে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

এবার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি-

গত সেপ্টেম্বর মাসে একটা ফ্যামিলি ট্যুরে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাদহ এবং যশোর গিয়েছিলাম একটা মাইক্রোবাস নিয়ে। আমি বসেছিলাম ড্রাইভারের পাশে অর্থাৎ সেকেন্ড সিটে। রাস্তা খেয়াল করে যাচ্ছিলাম, ড্রাইভারকে সজাগ রাখছিলাম। হাইওয়ে, প্রচন্ড গতি, ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার। ফাঁকা রাস্তা, হঠাৎ খেয়াল করলাম সামনে একটি ট্রাক ডানে ইউটার্ন নেয়ার জন সংকেত দিয়ে ধীর গতিতে যাচ্ছিল। আমাদের গাড়ির গতি ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার থাকায় গাড়ি ব্রেক করা সম্ভব হয় নি, ড্রাইভার সেই টাকের ডান লেন দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দিল, ভাগ্যিস ট্রাকের ড্রাইভার গাড়ি ব্রেক করেছিল, না হলে আমাদের লাশসমেত গাড়িটিও খবরের কাগজ হতে পারতো। আমি ড্রাইভারকে বললাম – এটা কি হল? ড্রাইভার বললেন- স্যার গাড়ির গতি বেশি ছিল, ব্রেক করলেই এক্সিডেন্ট হতো। তার মানে গাড়ি অনিয়ন্ত্রিত ছিল। সুতরাং সেদিন আমি মনে বুঝেছিলাম দুর্ঘটনার প্রথম কারণ অসাবধনতা এবং অনিয়ন্ত্রিত গতি।

-সাখাওয়াত স্বপন
চেয়ারম্যান, সেফটি ম্যানেজমেন্ট ফাউন্ডেশন
shakhawat2511@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *